পঞ্চগড়ে বাড়ছে লটকন আবাদ, লাভবান হচ্ছেন চাষিরা

বেশ কয়েক বছর ধরে উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে বাড়ছে ভিটামিন সি-সমৃদ্ধ লটকনের আবাদ। সদর উপজেলাসহ বিভিন্ন এলাকার চাষিরা আগ্রহী হচ্ছেন লটকন আবাদে। ফলটি আবাদে তেমন খরচ নেই। তাই অল্পতেই লাভবান হচ্ছেন চাষিরা। এতে করে ভিন্ন ভিন্ন আবাদে কৃষিতে সমৃদ্ধ হচ্ছে চা শিল্প অঞ্চলের এ জেলা।
গ্রীস্মকালীন ফল হিসেবে মৌসুমে এই ফলের চাহিদাও প্রচুর। এ বছর জেলায় ৬৩ হেক্টর জমিতে লটকনের আবাদ করেছেন চাষিরা। ভাল ফলন এবং দাম পাওয়ায় এই ফলের আবাদ প্রতি বছরই বাড়ছে।
জেলার অভ্যন্তরীন চাহিদা মিটিয়ে এসব ফল রপ্তানী করা হচ্ছে অন্যান্য জেলাতেও। এতে লাভবান হচ্ছেন চাষিরা। তবে চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংস ঘটনার পর লটকন বাইরে যেতে না পারায় দাম পাচ্ছেন না চাষিরা।
গ্রীস্মকালের ফল হিসেবে বাজারে বিভিন্ন ফলের দোকানে পাওয়া যাচ্ছে লটকন। জানা গেছে, ফল ব্যবসায়ীরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে চাষিদের গাছ থেকে লটকন সংগ্রহ করছেন। অনেক ব্যবসায়ী চুক্তিতে কিনে নেন বাগান ও গাছের ফল। পরে গাছ থেকে পেড়ে তা প্যাকেট জাত করে দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বিক্রি করে থাকেন।
কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৬০ মিটার উঁচুতে অবস্থানের কারণে জেলার অধিকাংশই মাটিই বেলে দোঁয়াশ প্রকৃতির। তাই লটকন চাষের জন্য এখানকার মাটি খুবই উপযোগী। একইসঙ্গে মাটিতে বালু ও পাথরের আধিক্য বেশি থাকায় বেশ কয়েক বছর ধরে উন্নতজাতের আম, আঙ্গুর, কমলা, মাল্টাও আবাদ হচ্ছে লটকনের পাশাপাশি। এছাড়া দীর্ঘকাল ধরেই জাম, কাঁঠাল, লিচু, জাম্বুরা, জলপাই, ডাউয়া—জাতীয় দেশি ফলের আবাদ হয়ে আসছে ।
লটকন আবাদে চাষিদের সুবিধাজনক দিক হলো— এরজন্য বাড়তি জমির প্রয়োজন হয় না, বাড়ির আশেপাশে পতিত জমি কিংবা চা-সুপারি বাগানে সাথী ফসল হিসেবে লটকনের আবাদ করতে দেখা যায়। গাছ থেকে পাকা লটকন পড়ে কিছুদিন পর সেখানেই চারা গজায়। চারা গজানোর পর ৫ থেকে ৬ ইঞ্চি লম্বা হলে তা চারার প্যাকেটে বেডে রাখা হয়। বেডে চারা ১০ থেকে ১২ ইঞ্চি লম্বা হলে জমিতে লাগানোর উপযোগী হয়।
তবে বর্তমানে নার্সারী ব্যবসায়ীরা মূল গাছ থেকে কলম করে তা বাণিজ্যিকভাবে বিক্রয় করছেন। এতে করে বীজের গাছের তুলনায় কলম গাছে তাড়াতাড়ি ফল ধরে। পরিমিতভাবে জৈব সারসহ অন্যান্য রাসায়নিক সার প্রয়োগ করলে কলম গাছে ৩-৪ বছরে ফল ধরে।
শুরুতে ফল কিছুটা কম হলেও গাছ বড় হওয়ার সাথে সাথে ফলও বাড়তে থাকে। গাছে গোড়া থেকে মগডাল পর্যন্ত লটকন ধরে। সুস্বাদু এই ফল চাষে খুব বেশি খরচ নেই। গোবর সার ছাড়া অন্য কোনো রাসায়নিক সার প্রয়োজন হয় না। সাধারণত একটি বড় গাছে প্রতি বছর ২০ মন পর্যন্ত লটকন পাওয়া যায়। অন্যান্য ফলের গাছের তুলনায় লটকন গাছে কীট পতঙ্গ আক্রমণের হার খুবই কম। তবে গাছে ফল পাকা শুরু করলে বাদুরসহ পাখির উপদ্রব বাড়ে।
দিন দিন লটকনের চাহিদা ও দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ৯ বিঘা জমির সুপারী বাগানে সাথী ফসল হিসেবে ৭০টি লটকন গাছ লাগিয়েছেন দেবীগঞ্জ উপজেলার চিলাহাটি ইউনিয়নের তিস্তাপাড়া গ্রামের গকুল চন্দ্র রায়। কয়েক বছর ধরে তিনি এসব গাছ থেকে লটকন বিক্রি করে লাভবান হয়েছেন। গকুল চন্দ্র রায় জানান, আলাদা কোনো জমিতে নয়, সুপারি বাগানেই ৭০টি লটকনের গাছ লাগিয়েছি। এ বছর ৩ লাখ ২০ হাজার টাকার লটকন বিক্রি করেছি।
সুপারির বাগানে ১৫টি লটকন গাছ লাগিয়ে বেশ অর্থ পাচ্ছেন জেলার সদর উপজেলার চাকলাহাট এলাকার লটকন চাষি শহিদুল্লাহ। তিনি জানান, লটকন চাষে পরিশ্রম নেই বললেই চলে। এবার আমি ৪৮ হাজার টাকার লটকন বিক্রি করেছি। একই কথা বলেন হাড়িভাষা এলাকার আব্দুল হাই। তিনি বলেন, লটকন ফল বিক্রি নিয়ে আমাদের চিন্তা করতে হয় না। লটকন ফলন ধরার পর জমিতেই পাইকারি বিক্রি করে দেওয়া যায়। পাইকাররা বাগান থেকেই লটকন কিনে নিয়ে যান। এই ব্যবসায়ীরা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে রপ্তানি করেন।
এছাড়াও পঞ্চগড় জেলা সদরের বলেয়াপাড়া গ্রামের মো. সফিউল্লাহ, বোদা উপজেলার বড়শশী ইউনিয়নের হরিষ চন্দ্র রায় লটকন আবাদ করে আসছেন। তারা কেউ পাঁচ বছর কেউ আরও আগে থেকে লটকন আবাদ করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছেন।
জেলার সদর ও তেঁতুলিয়াসহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, ফলের দোকানগুলোতে লটকন বিক্রি হচ্ছে। দোকানগুলোতে ফলটি বিক্রি হচ্ছে কেজি দরে। এক কেজি লটকন ৮০ টাকা।
তেঁতুলিয়ার ফল ব্যবসায়ী রুহুল আমিন বলেন, এ সময়টাতে লটকনের চাহিদা রয়েছে। বাজারে আমরা ৮০ টাকা কেজি বিক্রি করছি। অনেকেই কিনছেন।
দেবীগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা নাঈম মোরশেদ জানান, দেবীগঞ্জ উপজেলায় বেশ কয়েকজন চাষি লটকন আবাদ করছেন। লটকন চাষে তেমন বাড়তি জমি লাগে না। সাথী ফসল হিসেবে এটি আবাদ করে লাভবান হওয়া সম্ভব। তাই লটকন চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণ, পরামর্শ প্রদানে কৃষি সম্প্রসারন বিভাগ কাজ করে যাচ্ছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আব্দুল মতিন বলেন, জেলায় এবার ৩৩ হেক্টর জমিতে লটকনের চাষ হয়েছে। পঞ্চগড়ের মাটিতে আর্দ্র আবহাওয়ার কারণে লটকনের আবাদ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে আমরা চাষিদের সার্বক্ষণিকভাবে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিচ্ছি। চলমান পরিস্থিতির কারণে ব্যবসায়ীরা লটকন বাইরে বিক্রি করতে পারছেন না। এতে দাম কিছুটা কমছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে জেলার বাইরে রপ্তানী করা গেলে চাষিরা দাম পাবেন বলে মনে করছেন এই কর্মকর্তা।