সারাদেশ

২০০ বছর ধরে যেভাবে টিকে আছে বানারীপাড়ার ভাসমান হাট

এক পশলা বৃষ্টি থামতেই আবার ঘনিয়ে এলো মেঘ। নতুন রূপে সন্ধ্যা নদীর তীর। বর্ষার আকাশে সূর্যের দেখা নেই। মৃদু ঢেউ এসে ভেঙে যাচ্ছে তীরে। এর মাঝেই একে একে নৌযান ভিড়ছে পন্টুনে। কোনোটি ইঞ্জিনচালিত, কোনোটি বৈঠা। কেউ এসেছেন গলুইভর্তি চাল নিয়ে; কেউ ফিরছেন গলুই ভরে।

সকাল ৮টার মধ্যেই সরগরম হয়ে উঠেছে নদীর বুক। ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকডাক, পণ্য দেখে বুঝে নেওয়ার ব্যস্ততা আর দরকষাকষিতে প্রাণবন্ত পুরো অঞ্চল। ভাসতে ভাসতে ক্রেতা-বিক্রেতা সকলেই আসেন এখানে। যে কারণে নাম হয়েছে ভাসমান চালের হাট। চালের হাটের ঠিক ওপারটায় বসে ধানের হাট।

চালের হাট ভোর থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত, এরপর জমে ধানের হাট। চলে দুপুর ২-৩টা পর্যন্ত।

বরিশালের বানারীপাড়ার বিখ্যাত ধান-চালের ভাসমান হাটের চিত্র এমনই। স্থানীয়রা বলেন, ভাসানমহল। এ হাটে ক্রেতা-বিক্রেতা পর্যায়ের সকল লেনদেন তৎনগদ হয় বলে ‘নগদের হাট’ নামেও ডাকেন ব্যবসায়ীরা। ঠিক কত সালে প্রথম জমেছিল এ হাট, তার সঠিক তথ্য জানা নেই কারও। বংশপরম্পরায় ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছেন কারবারিরা। তাদের ধারণা, কমপক্ষে ২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এখানে জমে আসছে হাট, যেখানে প্রতিদিন প্রায় দেড় হাজার মণ ধান ও চাল বিকিকিনি হয়। হাটের চিত্র দেখতে দেশ ও দেশের বাইরে থেকেও পর্যটকরা ছুটে আসেন বানারীপাড়ায়।

জেলা সদর থেকে ১৮ কিলোমিটার পশ্চিমের উপজেলা বানারীপাড়া। এ উপজেলা সদরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া স্রোতস্বীনি সন্ধ্যা নদীর তীরে প্রতি শনি ও মঙ্গলবার জমে ভাসমান হাট। এ দুদিন প্রধানত হাটবার হলেও ক্রেতা-বিক্রেতা বাড়লে রোববার আর বুধবারও তা বর্ধিত করা হয়। স্থানীয়রা বর্ধিত সময়কে বলেন ‘গালা’।

বুৎপত্তিগত দিক দিয়ে উপজেলার নামকরণের সঙ্গে বাণিজ্যের নিবিড় সম্পর্ক। বানারীপাড়া নামকরণে যতগুলো কিংবদন্তী পাওয়া যায় এর মধ্যে সবচেয়ে অর্থবহ বেনিয়া শব্দের কথ্যরূপ বানারী। নদীবিধৌত এ জনপদে শতাব্দীকাল আগেও বেনিয়ারা পাড়া করে বসবাস করতেন। বেনিয়াদের কথ্যরূপ বানারীর সঙ্গে পাড়া যুক্ত হয়ে পুরো উপজেলার নামকরণ হয় বানারীপাড়া।

 

১৩৪ কিলোমিটারের কিছু বেশি আয়তনের বানারীপাড়া উপজেলা সন্ধ্যা, হারতা, নলশ্রী, জৈনকাঠি আর স্বরূপকাঠি নদীবেষ্টিত। নদীগুলোর অসংখ্য শাখা-প্রশাখা খাল-গাছের শিকড়ের মতো জড়িয়ে রেখেছে জনপদকে। এসব নদী-খালের বদৌলতে আজও প্রাণবন্ত ভাসমান হাট।

স্থানীয় ষাটোর্ধ্ব ক্রেতা এনায়েত হোসেন বলেন, দক্ষিণের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ধান কিনে এনে এ হাটে বিক্রি করা হতো। এখান থেকে তা কিনে কুটিয়ালরা নিজস্ব পদ্ধতিতে চাল তৈরি করে আবার এ হাটেই বিক্রি করত। তখন হাজার হাজার নৌকা আসত, এখন আর অত আসে না। তবে, এখনও এটি গুরুত্বপূর্ণ। বানারীপাড়ায় মলঙ্গা নামে একটি গ্রাম আছে। যেখানে বিখ্যাত বালাম চাল তৈরি হতো।

‘ছোট বেলায় দেখেছি বড় বড় কার্গো-লঞ্চে করে এখান থেকে চাল নিয়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে নেওয়া হতো।’

কারবারি মিজানুর রহমান বলেন, আমার দাদা-বাবা ধান-চালের ব্যবসা করতেন। বংশপরম্পরায় আমি ১৮ বছর ধরে এ ব্যবসায় আছি। বানারীপাড়ায় মূলত কুটিয়ালদের ওপর নির্ভর করে ব্যবসা টিকে আছে। তবে, বিভিন্ন স্থানে অটোরাইস মিল হয়ে যাওয়ায় কুটিয়ালের সংখ্যা কমেছে। তারপরও এ অঞ্চলের ব্যবসার কেন্দ্র এখনও বানারীপাড়ার ভাসমান হাট। বিগত বছরের তুলায় এবার ব্যবসা ভালো হচ্ছে।

সাবেক ইউপি সদস্য ও পাইকারি ব্যবসায়ী আব্দুল হাই বলেন, ভাসমান হাট ভালো শব্দে বললেও আমরা ভাসানমহল হিসেবে চিনি। পাকিস্তান আমল থেকে দেখে আসছি এখানে বরগুনা, ভোলা, খেপুপাড়া, চরদুয়ানি, জ্ঞানপাড়া, পিরোজপুর, খুলনা, সাতক্ষীরা থেকে ব্যাপারীরা ধান নিয়ে আসত। ধান বিক্রি হলে চাল কিনে নিয়ে যেত যার যার এলাকায়। ভাসানমহল আমাদের আয়ের প্রধান উৎস। এখনও প্রতি হাটে এক-দেড় হাজার মণ বেচাকেনা হয়।

গোপালগঞ্জ থেকে ধান নিয়ে আসা ব্যবসায়ী আব্দুর রহমান বলেন, শুধু গোপালগঞ্জ নয়, বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ধান কিনে এখানে এসে বিক্রি করি। আমরা সাধারণত বীজ বপনের পরপরই ক্ষেত কিনে রাখি। ২০ বছরের বেশি সময় ধরে এখানে ব্যবসা করছি।

‘নদীপথে পণ্য পরিবহন সাশ্রয়ী এবং নির্ধারিত পণ্যের চেয়েও বেশি পরিমাণে নিয়ে গন্তব্যে যাওয়া যায়। ধরুন, একটি গাড়িতে ২০ মণ ধান নেওয়া যায়। কিন্তু ট্রলারে কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। আমি আজ ১২৫ মণ ধান কিনেছি। এতে সড়ক পথের চেয়ে খরচ ও পরিশ্রম কম’— বলেন কুটিয়াল মো. কাওছার। কেনা ধান থেকে চাল তৈরি করে এক সপ্তাহ পরে আবার চালের হাটে বিক্রি করবেন। বলেন, ‘বরিশাল অঞ্চল নদীবেষ্টিত হওয়ায় নদীপথ এখনও আমাদের আয়ের প্রধান উৎস।’

এ হাট থেকে চাল কিনে গ্রামে গ্রামে খুচরা বিক্রি করেন হানিফ ব্যাপারী। তিনি বলেন, ‘ভাসানমহলে সবধরনের ধান ও চাল পাওয়া যায়। গৃহস্থের চালও পাওয়া যায় এখানে। যার যেমন লাগে সেই পরিমাণে কিনে নিয়ে যায়। এখানে যে চাল পাওয়া যায় তা সম্পূর্ণ হাতে বানানো বিধায় ভাতের স্বাদ ও পুষ্টিগুণ ভালো থাকে।’

২০০ বছরের বেশি বয়স হলেও এ হাটে কোনো আড়তদার নেই। নেই খাজনা আদায়ের ব্যবস্থা। এমনকি বাকিতেও বিক্রি হয় না পণ্য। যে কারণে মধ্যস্বত্বভোগীদের কোনো দৌরাত্ম্য তৈরি হয়নি। বিক্রেতারা নৌযানে করে পণ্য নিয়ে এসে হাটের সীমানায় নোঙর করেন। ক্রেতা এসে পছন্দ মতো পরখ করে প্রয়োজনীয় ধান-চাল নগদ টাকায় কিনে নিয়ে যান। নৌকায় বসেই পরিমাপ করে ক্রেতার নৌকায় পণ্য তুলে দেওয়া হয়। এজন্য অনেকেই এ হাটকে ডাকেন নগদের হাট বলে।

ধান-চালের হাটকে কেন্দ্র করে তীরে কয়েকটি দোকানও গড়ে উঠেছে। যেখানে রুটি, কলা, ডাব, পানি, পান, চা পাওয়া যায়। অনেকেই নৌকায় করে সবজি বিক্রি করতে আসেন।

সবজিবিক্রেতা শামসুল হক বলেন, এ হাটে সবজিও ভালো বিক্রি হয়। ভোর থেকে অনেক মানুষ থাকায় যার যে সবজি দরকার হয় কিনে নিয়ে যায়। মৌসুম অনুসারে যে সবজি দরকার তা বাজার থেকে কিনে এনে এখানে বিক্রি করি। নিজের ক্ষেতের সবজিও বিক্রি করি। ভাসানমহলের ওপর নির্ভর করেই আমার সংসার চলে।

গবেষক আনিসুর রহমান খান স্বপন বলেন, বানারীপাড়ার ধান-চালের ভাসমান হাট দক্ষিণাঞ্চলের ঐতিহ্যের একটি অংশ। এ অঞ্চলে, বিশেষ করে নদী এলাকার ব্যবসা ও বিনিয়োগের কেন্দ্রবিন্দু এটি। বিভিন্ন কারণে হাটটি আগের মতো জমজমাট না থাকলেও এখনও এর গুরুত্ব বেশ।

‘আমাদের নদী-অর্থনীতি এবং নদীকেন্দ্রিক ব্যবসার প্রসারে বানারীপাড়ার হাটটি উদাহরণ হতে পারে। কারণ, এ হাটের সঙ্গে সম্পৃক্ত কৃষক, ভোক্তা, পাইকার ও কুটিয়াল। ঐতিহ্যবাহী এ ব্যবসায়িক কেন্দ্রকে প্রসারিত করতে স্থানীয় প্রশাসনের এগিয়ে আসা উচিত।’

বানারীপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অন্তরা হালদার বলেন, ধান-চালের ভাসমান হাট শুধু স্থানীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেনি, যুগ যুগ ধরে এর সুখ্যাতি ছড়িয়েছে দেশ ও দেশের বাইরে। হাটটি যেহেতু নদীতে মেলে, এজন্য খাজনা মওকুফ করা হয়েছে। ফলে এ হাটে ব্যবসা করতে ক্রেতা-বিক্রেতা সকলেই বেশ আগ্রহী। আমি মনে করি, নদী যত দিন থাকবে নদীকেন্দ্রিক এমন বাজার এবং বাজারকেন্দ্রিক অর্থনীতিও টিকে থাকবে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Discover more from ঝিনেদা টিভি

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading