জেলার খবরঝিনাইদহ

বন্ধু আক্তারুজ্জামানের আলিশান বাংলোয় যাতায়াত ছিল এমপি আনোয়ারুল আজীমের

কলকাতায় হত্যার শিকার সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম ও হত্যাকাণ্ডের ‘মূল পরিকল্পনাকারী’ আক্তারুজ্জামান শাহীনকে বন্ধু হিসেবেই জানতেন এলাকার মানুষ। যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী শাহীন ঝিনাইদহে এলে থাকতেন নির্জন এলাকায় গড়ে তোলা আলিশান বাংলোবাড়িতে। সেখানেই দুজনের একান্তে আলাপ হতো। এমন দুই দিন ওই বাংলোয় সংসদ সদস্য আনোয়ারুলের সঙ্গে ছিলেন তাঁর আরেক বন্ধু গোলাম রসুল।

মোবারকগঞ্জ চিনিকল শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি গোলাম রসুলের মতে, আনোয়ারুল ও আক্তারুজ্জামানের বন্ধুত্ব প্রায় ৩০ বছরের। পাশের কোটচাঁদপুর উপজেলার এলাঙ্গী গ্রামে শাহীনের ওই বাংলোয় প্রথমবার তিনি গিয়েছিলেন বছরখানেক আগে। তিন-চার মাস আগে শেষবার আনোয়ারুল তাঁকে ওই বাংলোয় নিয়ে গিয়েছিলেন।

আনোয়ারুল আজীম ওরফে আনারের স্কুলজীবনের বন্ধু গোলাম রসুল প্রথম আলোকে বলেন, একদিন দর্শনা থেকে বাড়ি ফেরার পথে আনোয়ারুল তাঁকে বলেছিলেন, ‘চলো বন্ধু শাহীনের সঙ্গে দেখা করে আসি।’ এরপর তাঁরা দুজন ওই বাংলোতে যান। আনোয়ারুল একান্তে শাহীনের সঙ্গে কথা বলেন। তবে তিনি (রসুল) বাইরে বাংলোর মধ্যে একটি কক্ষে বসে অপেক্ষা করেছিলেন।

রসুল বলেন, বাংলো দেখে তিনি হতবাক হন, এই গ্রামের মধ্যে এত ভিআইপি বাংলো। যেখানে বিদেশি কুকুর, অনেক কর্মচারী, ভিআইপি আসবাব দিয়ে সাজানো। আনোয়ারুল তাঁকে বলেছিলেন, শাহীন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। এখানে বেড়াতে এলে এই বাংলোতে অবস্থান করেন।

অবশ্য শাহীনের বড় ভাই কোটচাঁদপুর পৌরসভার মেয়র মো. সহিদুজ্জামান সেলিমের ভাষ্য, পাঁচ থেকে ছয় বছর হলো তিনি দেখেছেন শাহীন আর আনোয়ারুল বন্ধু। এর আগে তাঁদের বন্ধুত্ব থাকলেও তাঁর জানা ছিল না। এই পাঁচ-ছয় বছর শাহীন এলাকায় এলে আনোয়ারুল তাঁর সঙ্গে দেখা করতেন। তাঁদের মধ্যে কোনো ব্যবসা ছিল কি না, তা তিনি বলতে পারেন না।

সহিদুজ্জামান আরও বলেন, তাঁর ভাই গত রমজানের আগে বাড়িতে এসেছিলেন। এরপর আমেরিকায় চলে যাচ্ছেন বলে বাড়ি থেকে বের হয়েছেন। এর মাঝে ভারতে গেছেন কি না, তা তিনি জানেন না। এখন ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমের হত্যার পরিকল্পনাকারী হিসেবে শাহীনের নাম আসছে। সেলিমুজ্জামান বলেন, ভাই যদি অপরাধী হয়, তাঁর বিচার হবে, এটা তিনিও আশা করেন।

কোটচাঁদপুর শহরে সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, চায়ের টেবিল, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি অফিসগুলোতে আক্তারুজ্জামান শাহীনকে নিয়ে আলোচনার ঝড় বইছে। স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, শাহীন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হয়ে কিছুদিন চট্টগ্রাম অঞ্চলে চাকরিতে যান। অল্প কয়েক মাস চাকরির পর ছেড়ে দিয়ে ঢাকায় ব্যবসা শুরু করেন। দেশে ও দেশের বাইরে নানা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তবে তাঁর কী ব্যবসা ছিল, কেউ তা বলতে পারেন না। একসময় যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান, সেখানে ব্যবসা করেন বলে সবাই জানতেন। মাঝেমধ্যে বাড়িতে আসতেন, আবার চলে যেতেন। তবে এলাকার রাজনীতিতে এবং নির্বাচন এলেই অর্থ ছড়িয়ে প্রভাব বিস্তার করতেন শাহীন।

এলাঙ্গী গ্রামের এক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ছয় থেকে সাত বছর আগে এলাঙ্গী গ্রামের মাঠের মধ্যে ২৫ বিঘা জমির ওপর শাহীন একটি বাংলোবাড়ি গড়ে তোলেন। মাঠের মধ্যে নির্জন এলাকায় গড়া বাংলোর পাশে কোনো বসতি নেই। দেশ ও দেশের বাইরে থেকে মালামাল এনে অত্যাধুনিকভাবে নির্মাণ করা হয় এই বাংলো। বাংলোর নিরাপত্তায় বড় বড় গেট তৈরি করা হয়েছে। গোটা এলাকা সিসিটিভি ক্যামেরা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সাধারণের পক্ষে ভেতরে প্রবেশ করা সম্ভব নয়। নিরাপত্তাকর্মীও রাখা হয়েছে বেশ কয়েকজন। বাংলোতে নানা কাজে নানা শ্রমিক রয়েছেন, যাঁদের বেশির ভাগ কোটচাঁদপুরের বাইরের। স্থানীয় লোকজনকে সেখানে ঢুকতে দেওয়া হয় না। ভেতরে বিদেশি একাধিক কুকুর পোষা হয়।

ওই ব্যক্তি আরও বলেন, এখানে মাঝেমধ্যেই রাতে বড় বড় গাড়ি আসে। এখানে তাঁরা এসে সময় কাটান। ভেতরে কী হয়, তা তাঁদের বোঝার উপায় নেই। শুধু এটুকু জানেন, মনোরঞ্জনের জন্য এই বাংলো তৈরি করা হয়েছে। শাহীন যখন এলাকায় থাকেন, তখন ওই মানুষগুলো বেশি আসেন। অন্য সময়ও তাঁদের আসতে দেখা যায়।

শাহীনের বড় ভাই সহিদুজ্জামান বলেন, ২৫ বিঘা জমির ওপর শাহীন বাংলোটি তৈরি করেছেন। তাঁদের পৈতৃক জমির সঙ্গে কিছু জমি কিনে এটা করা হয়েছে। শাহীন বিদেশ থেকে বাড়িতে এলে এই বাংলোয় অবস্থান করেন। এখানে কারা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন, এটা তাঁর জানা নেই।

আক্তারুজ্জামান শাহীনকে গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশ খুঁজছে। তদন্ত–সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, কলকাতার নিউ টাউনে আক্তারুজ্জামানের ভাড়া করা ফ্ল্যাটেই ১৩ মে রাতে খুন করা হয় আনোয়ারুল আজীমকে। তার আগে ওই ফ্ল্যাটে হত্যাকাণ্ডের ছক কষে আক্তারুজ্জামান ১০ মে বাংলাদেশে চলে আসেন। তাঁর সহযোগীরা ফ্ল্যাটে থেকে যান। আনোয়ারুল খুন হওয়ার পর আক্তারুজ্জামান গত সোমবার ঢাকা থেকে একটি ফ্লাইটে দিল্লি হয়ে কাঠমান্ডু চলে গেছেন।

গোয়েন্দা সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে, সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম ও আক্তারুজ্জামানের বিরুদ্ধে স্বর্ণ চোরাচালান ও হুন্ডিসহ আন্তর্দেশীয় বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসার তথ্য রয়েছে। দুজনের মধ্যে দ্বন্দ্বের জেরে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় বলে তদন্তকারীরা ধারণা করছেন।

এদিকে আজ বৃহস্পতিবারও সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমের কালীগঞ্জ শহরের নিশ্চিন্তপুর এলাকার বাড়িতে শত শত নেতা-কর্মীকে ভিড় করতে দেখা গেছে। তাঁরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন মরদেহ কখন আসবে, নতুন কী খবর আসবে। আজ সকালে আনোয়ারুলের বাড়ির সামনে দলীয় কার্যালয়ে আসেন কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. আয়ুব হোসেন খান। তিনি দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের নিয়ে বসেন।

কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. ওহিদুজ্জামান জানান, তাঁরা দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও কালো পতাকা উত্তোলন এবং দলের নেতা-কর্মীরা কালো ব্যাজ ধারণের মাধ্যমে শোক পালন করছেন। সংসদ সদস্যের লাশ না পাওয়া পর্যন্ত এই কালো ব্যাজ ধারণ চলবে। এ ছাড়া আগামীকাল শুক্রবার জুমার নামাজের পর ঝিনাইদহ-৪ সংসদীয় আসনের সব মসজিদে দোয়া মাহফিল করবে। এ ছাড়া শনিবার সকাল ১০টায় উপজেলা আওয়ামী লীগের সভা আহ্বান করা হয়েছে। এখানে পরবর্তী কর্মসূচি নেওয়া হবে বলে জানান ওহিদুজ্জামান।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Discover more from ঝিনেদা টিভি

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading